ভোরের আলো তখনও পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি দুর্গাপুরের হাট কানপাড়া বাজারের দিকে। চারপাশে যেন এক ধরনের নিস্তব্ধতা। এমনই এক সকালে, সবজি খেতে যাওয়ার পথে এক কৃষক থমকে দাঁড়ান বাজুখলসী এলাকার একটি গাছের নিচে। গাছের ডালে ঝুলছে এক যুবকের নিথর দেহ। ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক, ভেঙে পড়ে নিরবতা। গাছে ঝুলে থাকা সেই যুবকের নাম মো. শুভ আহমেদ, বয়স মাত্র ২৫।স্থানীয়রা জানালেন, শুভ ছিলেন ভদ্র, শান্ত ও কম কথা বলা স্বভাবের। তবে তার মধ্যে এক ধরনের অভিমানী মনোভাব ছিল, যা অনেক সময় তাকে একা করে দিত। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক, কোনো বড় ধরনের দ্বন্দ্ব বা কলহের কথা কেউ বলেননি। কিন্তু শুভ প্রায়ই নিজ মনে গুটিয়ে যেতেন, কারও সঙ্গে গভীরভাবে মিশতেন না।”সবার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলত, কিন্তু মনে হতো ভিতরে কিছু চাপা পড়ে আছে। আমরা কখনো ভাবিনি এমন কিছু করে বসবে,” — বললেন এক প্রতিবেশী, যিনি শুভকে ছোটবেলা থেকেই চেনেন।পরিবার জানায়, সোমবার রাতে শুভ স্বাভাবিকভাবেই ছিলেন। কারও সঙ্গে তেমন কোনো বিশেষ কথাও হয়নি। কোনো আলাদা ইঙ্গিত বা আচরণও ছিল না। রাত গভীর হওয়ার পর সবাই যার যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েন। আর শুভ হয়তো তখনই নিজ সিদ্ধান্তে এগিয়ে যান মৃত্যুর দিকে।পুলিশ জানায়, ঘটনাস্থলে তেমন কোনো চিঠি বা স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরিবারও অভিযোগ না করায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়। দুপুর ২টায় জানাজা শেষে তার দাফন সম্পন্ন হয় পারিবারিক কবরস্থানে।এই মর্মান্তিক ঘটনা দুর্গাপুরবাসীর মনে গভীর শোকের ছায়া ফেলেছে। অনেকে প্রশ্ন করছেন—একজন তরুণ, যার জীবন ছিল সামনে পড়ে, কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল?মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সময়ে তরুণদের মধ্যে বিষণ্নতা, মানসিক চাপ ও একাকীত্ব বাড়ছে। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে সমাজে কথা বলার সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। আত্মহত্যার প্রবণতা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে, অথচ আমরা এখনো এসব বিষয়কে ‘লজ্জার’ বিষয় হিসেবে দেখি।স্থানীয় শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার সুযোগ কম। শুভ যদি নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারত, হয়তো তাকে আমরা হারাতাম না।”তিনি আরও বলেন, “শুধু পরিবার নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা ও সহমর্মিতা তৈরি না হলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।”একজন তরুণের জীবন থেমে গেল, নিঃশব্দে। শুভ আহমেদের আত্মহত্যা শুধু একটি ব্যক্তিগত ঘটনা নয়—এটি আমাদের সমাজের, পারিবারিক সম্পর্কের এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। আমরা যদি এখনই পরিবর্তন না করি, তাহলে হয়তো আগামী ভোরেও কারও নিথর দেহ ঝুলতে দেখা যাবে কোনো এক গাছের ডালে—আমরা শুধু দাঁড়িয়ে দেখব, কাঁদব, এবং আবার ভুলে যাব।#এনআই
Source: সময়ের কন্ঠস্বর