দীর্ঘ প্রায় আট বছরের নিষ্ক্রিয়তা ও সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটিয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি প্রাথমিক সদস্য নবায়ন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে নিজেই সদস্য ফরম পূরণ ও কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রমের সূচনা করেন। এর মাধ্যমে বিএনপির সাংগঠনিক পুনর্গঠনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।উদ্বোধনের পর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ দেশব্যাপী সকল ইউনিটের নেতাকর্মীদের প্রাথমিক সদস্যপদ নবায়নের তাগিদ দেন। তবে চার মাস পেরিয়ে গেলেও কর্মসূচিটি প্রত্যাশিত গতি পায়নি। মাঠপর্যায়ে সংগঠনের ভঙ্গুর কাঠামো, অতীতের হতাশা এবং স্পষ্ট দিকনির্দেশনার অভাবে নবায়ন কার্যক্রম অনেকটাই ছিল ঝিমিয়ে পড়া।এই প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয়ভাবে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—পুরনো সদস্যদের নবায়নের পাশাপাশি এখন থেকে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তিও করা যাবে। তবে এর সঙ্গে সংযুক্ত হয় কড়া সতর্কতা! কোনোভাবেই ‘আওয়ামী সরকার’ ও তাদের ‘সহযোগীদের’ সদস্য করা যাবে না।১৫ মে কেন্দ্র থেকে একটি দাপ্তরিক নির্দেশনা পাঠানো হয় দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরে। এতে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের জেলা ও মহানগর ইউনিটের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবদের উদ্দেশে স্পষ্ট করে বলা হয়—স্থানীয়ভাবে কোনো সদস্য ফরম ছাপানো যাবে না। বিএনপি চেয়ারপারসনের স্বাক্ষরিত সদস্য বই কেবলমাত্র নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করতে হবে। প্রাথমিক সদস্য ফরম পূরণের পর এর অফিস অংশ কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা দিতে হবে সময়সীমার মধ্যে। এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে ১৫ মে থেকে। চলমে ১৫ জুলাই পর্যন্ত দুই মাসব্যাপী।নির্দেশনায় আরও বলা হয়, বিএনপির সদস্য হওয়ার জন্য অবশ্যই প্রার্থীর বয়স ১৮ বছর হতে হবে এবং তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। সমাজবিরোধী, সন্ত্রাসী কিংবা নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বিএনপির সদস্য পদ লাভের যোগ্য বিবেচিত হবেন না।নতুন নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ মে (শনিবার) চট্টগ্রাম বিভাগে আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্য নবায়ন ও নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর জেলা ও দক্ষিণ জেলা—এই তিন সাংগঠনিক ইউনিট একযোগে সদস্য সংগ্রহে নেমেছে বড় পরিসরে।চট্টগ্রাম মহানগরের ৪৩টি ওয়ার্ডে গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন করে সদস্য রয়েছেন। এই হিসাবে বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১২,৯০০ থেকে ১৫,০০০। এসব সদস্যদের নবায়ন করা হবে বলে সময়ের কন্ঠস্বর-কে জানিয়েছেন নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ। তিনি জানান, “বর্তমানে আমরা শুধু পুরনো সদস্যদের নবায়ন করছি। নতুন সদস্য নেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে এখনও স্পষ্ট গাইডলাইন পাইনি।”উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকার জানান, “আমরা ফেব্রুয়ারিতেই সদস্য নবায়ন কার্যক্রম শুরু করেছি। ইতোমধ্যে কেন্দ্র থেকে ৪৭ হাজার সদস্য ফরম সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে যে সদস্য সংগ্রহ অভিযান হয়েছিল, সেখানকার সদস্যরাই এখন নবায়নের আওতায় আসছেন। তবে ছাত্রদল বা যুবদলের কেউ বিএনপিতে আসতে চাইলে তারাও ফরম পূরণ করতে পারবেন।”দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব লায়ন হেলাল উদ্দিন বলেন, “২০১৬ সালে আমাদের সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ লাখ। এবার আমরা নতুন সদস্য এবং নবায়ন মিলিয়ে ১০ লক্ষ ফরম পূরণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছি।” তিনি জানান, “যারা বিতর্কিত, ফ্যাসিস্ট কিংবা অন্য দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদের সদস্যপদ দেওয়া হবে না।”চট্টগ্রাম মহানগরে বিএনপির সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম নতুন কিছু নয়। তবে এর ধারাবাহিকতা এবং সফলতা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ! ২০০৯ সালে সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হলেও শেষ হয়নি।২০১২ সালে আবারও উদ্যোগ নেওয়া হয়, মাঝপথে তা বন্ধ হয়ে যায়।২০১৬ সালে নগর বিএনপি নতুন সদস্য সংগ্রহ শুরু করে, টার্গেট ছিল ৪০ হাজার, সংগ্রহ হয় মাত্র ২০ হাজার।২০১৭ সালে সারাদেশে কেন্দ্রীয়ভাবে সদস্য সংগ্রহ শুরু হয়, মহানগরের লক্ষ্য ছিল ৫০ হাজার, পূরণ হয়নি।২০২১ সালে কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্য সংগ্রহ ফরম সরবরাহ করা হয়, নগর বিএনপি ফরম ছাপালেও দলীয় প্রতিবেদন সংগ্রহের কারণে কার্যক্রম স্থগিত হয়।একইভাবে ২০২২ মার্চ মাসে কার্যক্রম আবার শুরু হয়, অল্প কিছুদিন পর তা আবারো বন্ধ হয়ে যায়।বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, “যারা পূর্বে সরকারপন্থী ছিল কিংবা সাংগঠনিকভাবে শাস্তির আওতায় এসেছিল, তাদের কোনোভাবেই সদস্যপদ দেওয়া হবে না। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা না মেনে কাউকে সদস্যপদ দিলে সংশ্লিষ্ট নেতাদের জবাবদিহি করতে হবে এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) মাহবুবের রহমান শামীম জানান, “সদস্য সংগ্রহ একটি সাংগঠনিক রূপান্তরের অংশ। এতে শৃঙ্খলা থাকবে, ফ্যাসিস্ট বা সরকারপন্থী কেউ যাতে সদস্য হতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।”রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে চলমান এই সদস্য নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রমকে বিএনপির জন্য একটি সংগঠনিক পুনর্জাগরণের বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতি ও সাংগঠনিক কাঠামোয় দুর্বল হয়ে পড়া বিএনপি এই কর্মসূচির মাধ্যমে আবারও তৃণমূলে শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।তবে বিগত সময়ের ভঙ্গুর পরিকল্পনা, মাঝপথে থেমে যাওয়া কার্যক্রম, বিতর্কিত অন্তর্ভুক্তি এবং মাঠপর্যায়ে দলীয় শৃঙ্খলার অভাব—এসব যদি এবারও পুনরাবৃত্তি হয়, তাহলে এবারের প্রচেষ্টাও বিফলে যাবে।অন্যদিকে, যদি দলীয় নির্দেশনা ও শুদ্ধিকরণের নীতিমালাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে সংগঠন পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে চট্টগ্রাম বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ১০ লাখ পূরণে সক্ষম হবে বিএনপি।এসআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর