বলা হয় আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত, কিন্তু বাস্তবতা কাছে কথাটি সবার হয়ে ওঠে না, রাস্তা দিয়ে চলাফেরার সময় কতোইনা দেখি রাস্তায় ঝরে আছে পথফুল যা আমরা বলি পথশিশু। তাদের জীবন কাটছে নিঃসঙ্গ, তাদের মুখে হাসি নেই, দেখা যায় আশাহীন চেহারা। তবে তারাই বাঁচতে চাই স্বাভাবিক শিশুদের মতো জীবন নিয়ে। ঢাকার প্রতিটি পথে এই পথশিশু লক্ষ করা যায়, যা দেখতে খুবই বেদনা দায়ক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথভাবে তৈরিকৃত “স্ট্রিট সিচুয়েশন ইন বাংলাদেশ-২০২৪” প্রতিবেদনের অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৩৪ লাখেরও বেশি মা-বাবাহীন পথশিশু রয়েছে যারা অবহেলা ও অনাদরে, অনাহারে দিনযাপন করছে। এই শিশুদের দেখলে মনে হয় দেশের প্রায় ৫৪ বছরেও আমরা কেউ কারো জন্য হতে পারি নি যা অতি দুঃখজনক। মাঝে মাঝে মাথায় ভাবনায় আসে এই সভ্য সমাজে পথশিশুদের জন্য কেউ নেই? কেনো এই ফুল গুলোর যত্ন না নিয়ে ছুড়ে পেলে রাখছি রাস্তায়? শিশু-অধিকার কীভাবে নিশ্চিত হবে, যদি এখনো ‘পথশিশু’ শব্দটা থাকে?শিশু হচ্ছে আগামী বাংলাদেশ তবে দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের অনেক রাস্তার ছেলে-মেয়ে কম বয়সে মারা যায়। তারা তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ মানসিক ও শারিরীক বিকাশের জন্য খাবার ও বাসস্থান পায় না। প্রতিবছর জলবাহিত রোগে ১,১৫,০০০ শিশুর মৃত্যু হয়। এই শিশুরা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পায় না, চরম অপুষ্টিতে ও খারারের অনিয়মে ভোগে, অনেক সময় তাদের ময়লা বাসি, খাওয়ার অযোগ্য খাবারও খেতে হয়, যা স্বাভাবিক মানুষ তা ডাস্টবিনে পেলে দেয়, এইরুকুম খাবার খেয়ে তাদের খুদার মিটাই।ঢাকার পথে ঘাটে লক্ষ করা যায় এই পথশিশু গুলো জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা ভিক্ষাবৃত্তি, চায়ের দোকান, কল-কারখানা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, বর্জ্য সংগ্রহ, ফুল বিক্রি, পত্রিকা বিক্রিসহ বিভিন্ন কাজ করে এবং অতি দুঃখ প্রকাশ করে বলতে হচ্ছে তাদের কর্মক্ষেত্রে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়,কিছু কিছু জরিপের মাধ্যমে পথশিশুদের ওপর সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় মেয়ে পথশিশুদের। মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। পরিচয়হীন বা পিতৃপরিচয় না থাকায় অনেক পথশিশুকে মানসিক নিপীড়ন, হেনস্তা, অশ্লীল ভাষায় গালাগালি শোনা সহ বিভিন্ন ধরনের কটূক্তির শিকার হতে হয়। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তার শিশুদের জন্য একটি চমৎকার কবিতা লেখেছেন, সকালে উঠি আমি মনে মনে ভাবি সারাদিন আমি যেনো ভালোভাবে চলি, কিন্তু আমাদেন ভালো ভাবা হলেও পথশিশুদের ভাবা হয় না, তারা অনিশ্চিত ভাবনায় দিন কাটে। আমারা কত সুন্দর কত আরামে দিন কাটাচ্ছি, আমরা সকালে চখ খুললেই দেখি আমাদের মাথার উপরে ছাঁদ, কিন্তু পথশিশু তারা খোলা আকাশের নিচে দিন রাত্রিজাপন করছে। খোলা যায়গায় রাস্তা পাশে তারা থাকতে তাদের স্বাভাবিক অস্বাভাবিক আবহাওয়া, রাস্তা চলাফেরার গাড়িগুলোর অতিরিক সাউন্ড এবং হরণ তাদেন শরীল বিঘ্ন ঘটায় যা তারা অসুস্থতায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।যে বয়সে তারা স্কুলে যাওয়ার কথা, লেখাপড়া করার কথা, খেলাধুলা করা, আনন্দফুর্তি করা সে বয়সে কারা পড়াশোনাহীন সময় কাটছে। তাদের হাতে এখন বই নেই আবার দেখা যায়, পথশিশুদের মধ্যেই অর্ধেকই মাদকাসক্ত। তারা মাদকের ব্যবসা ও মাদক পাচারের সাথে যুক্ত থাকে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পথশিশুদের অর্ধেকের বয়স ‘১০’-এর নিচে। আর এসব পথশিশুর মধ্যে প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ মাদক সেবন করে। মাদকের মরণছোবল তাদের গ্রাস করে নিচ্ছে। গবেষণার তথ্যমতে, পথশিশুরা খুব সহজে মাদক সংগ্রহ করতে পারে। তাদের অনেকেই সরাসরি কারবারিদের কাছ থেকে মাদক কেনে।অনেক শিশু বিভিন্ন গ্যাং-এর সাথে যুক্ত হয়, যারা তাদের দিয়ে ভিক্ষা করায়। বরাদ্দকৃত টাকার কম ভিক্ষা করে আনলে তাদের খেতে দেওয়া হয় না, মারধর করা হয়, এছাড়া বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় তাদের ওপর। পথশিশুরা বেঁচে থাকা ও ভালোভাবে জীবনযাপনের জন্য চুরি করে এবং তাদের মধ্যে কিছু সংগঠিত অপরাধগোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয়। অপরাধগোষ্ঠীগুলো তাদের দিয়ে বিভিন্ন অপরাধ করায় এবং তাদের হিংস্র করে তোলে। পথশিশুদের অপরাধমূলক কার্যক্রম সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এটি সমাজের গুরুতর সমস্যা।বাংলাদেশের পথশিশুদের অর্ধেকই মাদকাসক্ত। তারা মাদকের ব্যবসা ও মাদক পাচারের সাথে যুক্ত থাকে। মাদকের মরণছোবল তাদের গ্রাস করে নিচ্ছে। নেশার ঝোঁক উঠলে, নেশার দ্রব্য জোগাড় করার জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে, সেটা যে অপরাধ হোক না কেনো। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তারা মাদকে জড়িয়ে যায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পথশিশুদের অর্ধেকের বয়স ‘১০’-এর নিচে। আর এসব পথশিশুর মধ্যে প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ মাদক সেবন করে। গবেষণার তথ্যমতে, পথশিশুরা খুব সহজে মাদক সংগ্রহ করতে পারে। তাদের অনেকেই সরাসরি কারবারিদের কাছ থেকে মাদক কেনে, এবং সেবন করে বা পাচার করে।পথে পথে দেখা যায় যে সহজলভ্যতা ও দামের স্বল্পতার কারণে পথশিশুরা ড্যান্ডি ও গাঁজা বেশি সেবন করে। অল্প খরচে ও সহজে পাওয়া যায় বলে অধিকাংশ পথশিশুর কাছে ড্যান্ডি বর্তমানে খুব জনপ্রিয় একটি মাদক। তারা যেখানে সেখানে তা সেবনে মগ্ন। ‘ড্যান্ডি’ মূলত এক ধরনের আঠা। “ড্যানড্রাইভ অ্যাডহেসিভ” বা “ড্যান্ড্রাইট” নামের আঠাটিকেই মাদকসেবীরা ‘ড্যান্ডি’ বলে। অনেক সময় দেখা যায়, তারা ফোলানো পলিথিনের মধ্যে নাক-মুখ ঢুকিয়ে এটি শোঁকে। তখন সেটি নেশার মতো কাজ করে তাদের শরীলে। দেশে শিশু কিশোরদের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে পথশিশুদের । পিতা-মাতার দারিদ্র্য ও কাজের অভাবের কারণে শিশুরা পথে নেমে কাজ করতে বাধ্য হয়, এতে তাদের শৈশব হারিয়ে যায়। তাই পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।পথশিশু-সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি সামর্থ্যবান, হৃদয়বান ব্যক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। পথশিশুদের কল্যাণে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কাজ করছে, কিন্তু এতেই যথেষ্ট নয়, সকলের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। আমাদের মানবিক চেতনা উন্নত করতে হবে। সামর্থ্যবানরা এদের দায়িত্ব নিলে আর পথশিশু থাকবে না। এই পথশিশু সমস্যা নিয়ে সামাজিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। সমাজের বৈষম্য দূর করতে হবে। বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের উদাসীনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। শিশুদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরিয়ে দেওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য। পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নে সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। তারাও দেশের সম্পদ। দেশের বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে তারাও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে, কিন্তু বিপুলসংখ্যক পথশিশুর মেধা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। এতে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে ক্ষতি হচ্ছে। রাষ্ট্র সমাজ তাদেরকে যথাযথ তাদের অধিকার দেওয়া উচিত এবং আগামী বাংলাদেশ তাদের হাতে সেভাবে তাদের কে তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।আজ মানবতা কোথায়? মানুষ মানুষের কাছে মর্যাদাহীন সমাজ কেনো? কেনো একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছি না? আজও কেন সদ্যজাত শিশুকে রাস্তায়, ময়লা-আবর্জনার ডাস্টবিনে পাওয়া যাচ্ছে? আমরা তাদের ময়লা-আবর্জনায় পরিণত করে ফেলছি। একটু ভালোবাসা, আদর-যত্ন দিলে তারাও আবর্জনার মাঝে রঙিন ফুল হয়ে ফুটতে পারে। এই ফুলদের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না, তাদের বাঁচাতে হবে। এদের বাঁচাতে আমাদের সবাইকে পদক্ষেপ নিতে হবে।আমি আর দেখতে চাই না পথশিশু নামক পথফুল রাস্তা ঝরে পড়ে থাকুক। আর চাই না শুনতে কোনো পথশিশুর আর্তনাদ। আর শুনতে চাই না তাদের কান্না করা আওয়াজে ঢাকার আকাশ ভারী হক। চাই না আর কোনো পথের ফুলের ঝরুক জীবন। এই মানবতার পৃথিবীতে তারাও পাক ঠাঁই, এই পৃথিবী হোক পথশিশুমুক্ত।এনআই
Source: সময়ের কন্ঠস্বর