“কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জরি কর্ণে-আমি ভূবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে।” কাজী নজরুল ইসলামগ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে যখন পথ চলা কষ্টকর হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যের প্রতীক হয়ে রাজশাহীর রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নদীর তীর জুড়ে মাথা তুলে দাঁড়ায় রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া। তার আভায় যেন প্রকৃতি মেতে ওঠে এক অন্যরকম উৎসবে। প্রতিটি পল্লব, প্রতিটি পাপড়ি যেন বলে ওঠে—এই নগরও রঙিন, এ শহরও কবিতাময়।রাজশাহীতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের প্রখর রোদ যখন নগরবাসীর কপালে ঘাম ঝরায়, তখন কৃষ্ণচূড়া তার আগুনরাঙা ফুলের মাধুর্যে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়। রুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কলেজ কিংবা পদ্মার তীর ঘেঁষা শহরের রাজপথ—সব জায়গাতেই এখন চোখে পড়ে কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম দ্যুতি। পাশেই কোথাও না কোথাও জারুলের বেগুনি ফুল যেন আরও সৌন্দর্য্য যোগ করে নগরজুড়ে।এই গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Delonix regia। এটি সিসালপিনিয়েসি গোত্রের অন্তর্গত, আর এর আরেক নাম গুলমোহর, যদিও বেশিরভাগ মানুষ এটিকে কৃষ্ণচূড়া নামেই চেনেন। কৃষ্ণচূড়ার সাধারণ রঙ লাল হলেও উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এটি হলুদ ও সাদা রঙেও ফুটে থাকে, তবে বাংলাদেশে লাল রঙেরই আধিক্য দেখা যায়।শুধু সৌন্দর্য্যই নয়, কৃষ্ণচূড়া বহুমুখী উপকারিতার গাছ। অনেকেই জানেন না, এই গাছের বিভিন্ন অংশ মানবদেহের চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তি, পেটের সমস্যা নিরাময়, এমনকি দাঁতের মাড়ির রোগ, খিচুনি, কলেরা ও মাসিকজনিত সমস্যায়ও ব্যবহৃত হয় এর পাতার নির্যাস। আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় একে বলা হয় ‘প্রাকৃতিক ফার্মেসি’।ম্যালেরিয়া ও কিডনির সমস্যায়ও এই গাছ ব্যবহৃত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। পাতার ক্বাথ ও রস নিয়মিত পান করলে দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ভাইরাল সংক্রমণেও উপকার পাওয়া যায়।রাজশাহীর আবহাওয়া ও মাটি কৃষ্ণচূড়ার জন্য বেশ অনুকূল। প্রতি বছর গ্রীষ্মে এই গাছগুলোর ফুল ফুটে প্রকৃতিকে রাঙিয়ে তোলে। পথচারীদের কাছে এটি যেন এক নিঃশব্দ সান্ত্বনা, একটুখানি ছায়া, একটু চমকানো রঙ। শহরের বুকে গজিয়ে ওঠা ইট-কাঠের ক্লান্ত দেহকে মুহূর্তেই সতেজ করে এই কৃষ্ণচূড়ার স্নিগ্ধ দ্যুতি।নগরবাসী বলছেন, “রাজশাহীর গ্রীষ্ম কল্পনাই করা যায় না কৃষ্ণচূড়া ছাড়া। এটা শুধু ফুল নয়, আমাদের আবেগ।”শুধু আবেগ নয়, পরিবেশ সংরক্ষণেও এই গাছের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে গাছ লাগানো একটি কার্যকর উপায়। কৃষ্ণচূড়া বড় আকারের ছায়া দেয়, বাতাস শীতল করে, এবং দূষণ কমাতে সহায়তা করে। এর ঘন পাতা সূর্যের তাপ রোধ করে এবং পরিবেশকে রাখে ঠাণ্ডা ও সতেজ।আধুনিক শহর পরিকল্পনায় এখন গাছের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এই গাছ সংরক্ষণে এবং নতুন করে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনও শহর জুড়ে কৃষ্ণচূড়া লাগিয়ে চলেছে। নাগরিকেরা একে শুধু ফুলের গাছ নয়, বরং শহরের পরিচয় হিসেবে দেখছেন।সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও কৃষ্ণচূড়া এক অনন্য প্রতীক। নজরুল থেকে শুরু করে আধুনিক কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় বারবার ফিরে এসেছে কৃষ্ণচূড়া। প্রেম, বিরহ, স্মৃতি কিংবা স্বপ্ন—সব অনুভবেই এই লাল ফুল অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে বারবার।ফটোগ্রাফার, শিল্পী, কবি এমনকি ভিডিও নির্মাতারাও এই গাছের সৌন্দর্য্যকে তাদের কাজে বেছে নিচ্ছেন।বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন ‘#krishnachura’ কিংবা ‘#redblossomrajshahi’ হ্যাশট্যাগে কৃষ্ণচূড়ার অসংখ্য ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ পদ্মার চরে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সেলফি তুলছেন, কেউ আবার তার প্রেমিকার অপেক্ষায় এই গাছের ছায়ায় বসে আছেন।রাজশাহীর শিক্ষার্থী রাহাত বলেন, “সেশনজট, ক্লাস, পরীক্ষা—সব চাপের মাঝেও কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে থাকলে মনের মধ্যে একটা শান্তি আসে।”এই শহরের কৃষ্ণচূড়াগুলো যেন একেকটি জীবন্ত চিত্রকর্ম। সূর্যাস্তের সময়ে যখন আকাশ লালচে হয়ে ওঠে আর কৃষ্ণচূড়ার পাপড়িগুলো বাতাসে ভেসে পড়ে, তখন পুরো শহর যেন এক কবিতায় রূপ নেয়।আজকের এই নগরায়নের যুগে আমরা যদি গাছের গুরুত্ব না বুঝি, তাহলে হারিয়ে যাবে এমন নান্দনিক প্রকৃতি। তাই কৃষ্ণচূড়ার মতো গাছগুলো রক্ষা করা, পরিচর্যা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। শুধু শহর নয়, গ্রামেও এই গাছ লাগানো হলে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা পাবে।শেষে ফিরে যাওয়া যাক নজরুলের সেই পঙক্তিতে— “আমি ভূবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে।” এই গন্ধ আর রঙ যেন আমাদের সচেতন করে, শিখায় প্রকৃতিকে ভালোবাসতে, রক্ষা করতে।রাজশাহীর রক্তিম কৃষ্ণচূড়া শুধু ফুল নয়, এটি আমাদের শেকড়, আমাদের কবিতা, আমাদের প্রাণ। তার সৌন্দর্য্য যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখুক প্রকৃতি আর মানুষের মেলবন্ধনে।এসআর
Source: সময়ের কন্ঠস্বর