কালের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার চাঁদশী গ্রামের জমিদার অন্মিকা চরন গুহ, কেদারনাথ বসু ও অন্যদা বসুর সকল ঐতিহাসিক নির্দশন। দখলকারীরা ক্রমেই নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে জমিদারদের পুরনো সব ঐতিহ্যকে। প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে আলাপকালে একই গ্রামের তিন জমিদারের প্রভাব প্রতিপত্তির কথা শোনা গেলেও তাদের অসংখ্য স্মৃতি আজ বিলীন হয়ে গেছে। দখল হয়ে গেছে তাদের বসত বাড়ি, দালান-কোঠাসহ যাবতীয় সহয় সম্পত্তি। চাঁদশী গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, ১৯৪৮ সালে দেশ বিভক্তির পর জমিদাররা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। পরবর্তীতে তারা আর ফিরে আসেননি। এ সুযোগে স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি জাল কাগজপত্র তৈরি করে জমিদারদের সহায় সম্পত্তি দখল করে নিয়েছেন। তারা নিজেদের স্বার্থে জমিদার বাড়ির পূজা মন্ডপ, সমাধী মন্দির ও দালান কোঠা ভেঙ্গে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। একইসাথে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে জমিদার বাড়ির সকল ঐতিহাসিক নিদর্শন।জমিদার অন্বিকা চরন গুহ ॥ উত্তর চাঁদশী গ্রামের প্রয়াত জমিদার অন্বিকা চরন গুহের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, জমিদারের সমাধীর নিচের অংশটি দখলদাররা ভেঙ্গে ফেলেছে। সমাধীর ইট-খোয়া দিয়েই মাত্র ৪/৫ গজ দুরত্বে তৈরি করা হয়েছে একটি শৌচাগার। শ্বেত পাথরের তৈরি কারুকার্য খচিত পঞ্চরত্ন নামে এ সমাধীটি নির্মিত হয়েছিলো বাংলা ১৩১৮ সালে। প্রায় ৩৫ ফুট সু-উচ্চ এ সমাধী মন্দিরের উপরিভাগে রয়েছে চারটি গম্বুজ। ১৩০১ সালে জমিদার অন্বিকা চরন গুহ মৃত্যুবরন করেন। তিনি বাড়ির সম্মুখভাবে খনন করিয়েছিলেন বিশাল দীঘি। ওই দীঘিটি গুহ বাড়ির দীঘি নামে এলাকায় ব্যাপক পরিচিত। দীঘির উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে বিশাল শান বাঁধানো ঘাটলা।প্রায় ১১ একর জমির ওপর জমিদার অন্বিকা চরন গুহের বাড়ি। ওই বাড়িতে ছোট-বড় বিভিন্ন আকারে ছয়টি পুকুর রয়েছে। জমিদার অন্বিকা চরন গুহ থাকতেন দ্বীতল ভবনে। বাড়িতে ছিলো জমিদারের দাওয়াখানা ও দূর্গা মন্দির। বাড়ির আশপাশে বাদ্যকর, নাপিত, ধোপা ও পাইক-পেয়াদারা থাকতেন। জমিদার বাড়িটি বারো মাসেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুখরিত থাকতো। অনুষ্ঠানের আগেই পঞ্চরত্নের ওপরে বসে ঢ্যাড়া পিটিয়ে এলাকার লোকজনদের দাওয়াত দেয়া হতো।সূত্রমতে, অন্বিকা চরন গুহের চার ছেলে ছিলো। তারা হলেন-রাইচরন গুহ, বিমল গুহ, কালি প্রসন্ন গুহ ও নলিনী গুহ। এরমধ্যে বিমল গুহ ছিলেন জেলা জজ। জমিদার অন্বিকা চরন গুহের বাড়িটি স্থানীয় প্রভাবশালী আয়নুল হক ও তার বড় ভাই আব্দুল হক ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে দখল করে নিয়েছেন।দখলদারদের পরিবারের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, আয়নুল হকের পিতা রিয়াজ উদ্দিন ছিলেন গ্রাম্য মোড়ল। তিনি নিলামে খরিদ করে ওই সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। ওই বাড়ির ৪ একর ৮ শতক সম্পত্তির দাবিদার চাঁদশী হাই স্কুল। জমি নিয়ে দখলদার পরিবারের সাথে চাঁদশী স্কুলের মামলা চলমান রয়েছে।জমিদার কেদারনাথ বসু ॥ জমিদার অন্বিকা চরন গুহ’র বাড়ির উত্তর পার্শ্বে মাত্র কয়েক’শ গজ দুরত্বে জমিদার কেদারনাথ বসুর বাড়ি। দ্বীতল ভবনে জমিদার কেদার নাথ থাকতেন। কারুকার্য খচিত ভবনের দেয়ালের চুনকাম অনেক আগেই খসে পরেছে। বাড়ির পূর্ব পার্শ্বেই বৌ-ঠাকুরানীর দীঘি। দীঘির দক্ষিণ পাড়ে পাকা ওয়াল ঘেরা শান বাঁধানো ঘাটলা।এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, জমিদার ওই দীঘিটি খনন করেছিলেন। কেদার নাথ তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন চাঁদশী ঈশ্বর চন্দ্র বসু মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯৪৮ সালে তিনি দেশত্যাগ করেন। ওই স্ট্রেটের কেয়ারটেকার ছিলেন জিতেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী। বর্তমানে ওই বাড়িতে তার চার ছেলে বসবাস করছেন।জিতেন্দ্রনাথের ছেলে অজিত কুমার (৭০) জানিয়েছেন, জমিদার কেদার নাথের বাড়িতে তিন খানা দুর্গা পূজা হতো। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পূজা উপলক্ষে জমিদার বাড়িতে নাচ, গান ও যাত্রানুষ্ঠানে মুখর থাকতো। জমিদার কেদারনাথের এক ছেলে ছিলো। তার নাম কালি দাস বসু। তিনি ভারতে চলে যাবার পর মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের জমিদারী চলতো বিল্লগ্রাম, বাশাইল, ধানডোবা ও চাঁদশী এলাকায়। খাজনা আদায়ের জন্য তাদের বিভিন্নস্থানে কাচারী ছিলো। জমিদার গুহ পরিবার ও বসু পরিবার চাঁদশী হাটের মালিক ছিলেন কিন্তু জমিদারী নিলাম হওয়ার কারনে সবকিছুই বেহাত হয়ে গেছে।জমিদার অন্যদা বসু ॥ জমিদার কেদারনাথ বসুর বাড়ির পূর্ব পার্শ্বেই আরেক জমিদার অন্যদা বসুর বাড়ি। বর্তমানে ওই বাড়িতে বসবাস করছেন জমিদার অন্যদা বসুর নাতী (মুকুন্দ নাথ বসুর ছেলে) তপন বসু। তপন বসু একাই আট একরের জমিদার বাড়ির বিশাল অট্টালিকায় বসবাস করছেন। ভবনটির বেহাল দশা, তাই তিনি কিছু অংশ ভেঙ্গে ফেলেছেন। এ বাড়ির রাধা কৃষ্ণের বিশাল মন্দিরটি এখনও সবার দৃষ্টি কাড়ে।তপন বসু বলেন, ১৯৪৮ সালে দেশ বিভক্তির পর তার দাদু (ঠাকুর দাদা) জমিদার অন্যদা বসু ভারতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। ১৯৭১ সালে পাক বাহিনী এ বাড়িতে হামলা চালিয়ে মন্দির ও তাদের দালানের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। ওইসময় তাদের হামলার কবল থেকে রেহাই পাবার জন্য পাশ্ববর্তী রাংতার ক্যাতনার বিলে পালাতে গিয়ে তার ছোট ভাই স্বপন বসু, বোন শেফালী ও জুথিকা বসু গুলিবিদ্ধ হয়ে একইসাথে শহীদ হন। বাড়ির লোকজন ওইসময় সহদর তিন শহীদকে বউ ঠাকুরানীর দীঘির পাড়ে মাটি চাঁপা দিয়ে রাখেন। শহীদ স্বপন বসু তখন ছিলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্র আর শেফালী ও জুথিকা ছিলো চাঁদশী স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্রী। জমিদারের নাতী তপন বসু ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাই তাদের বাড়িতে স্থানীয় রাজাকারদের ইশারায় পাক সেনারা হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে। তপন বসু ক্ষোভের সাথে বলেন, পাক সেনাদের নির্মম বুলেটে তার এক ভাই ও দুই বোন শহীদ হওয়া সত্বেও আজও তাদের শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এমনকি তার নামও অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।চাঁদশী গ্রামের তিন জমিদার বাড়ির আশপাশ ঘুরে দেখা গেছে জমিদারদের নানা স্মৃতি। প্রত্যেক জমিদার বাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে আলাদা রাস্তা ও খাল। এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, তিনজন জমিদার একইগ্রামে বসবাস করে তাদের জমিদারী পরিচালনা করলেও তাদের মধ্যে ছিলো না কোন বিরোধ, ছিলো সু-সম্পর্ক। ১৯১৫ সালে কেদার নাথ বসু চাঁদশী স্কুল প্রতিষ্ঠা করার সময় তৎকালীন গুহ বংশের জমিদার তাকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন। ১১৯২৪ সালে গুহ বংশের জমিদারের উপহার স্বরূপ একটি কাঠের আলমিরা আজও চাঁদশী স্কুলে স্মৃতি বহন করছে। কালের বির্বতনে ও দখলকারীদের উদাসিনতায় আজ ক্রমেই বিলিন হয়ে যাচ্ছে চাঁদশীর তিন জমিদারের সকল স্মৃতি।এনআই

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
বিশ্ব কণ্ঠ দিবসে প্রতিশ্রুতি: কণ্ঠস্বর সংরক্ষণে স্পিচ ও ভাষা থেরাপির গুরুত্ব
বিশ্ব কণ্ঠ দিবসে প্রতিশ্রুতি: কণ্ঠস্বর সংরক্ষণে স্পিচ ও ভাষা থেরাপির গুরুত্ব

আজ বুধবার (১৬ই এপ্রিল) বিশ্ব কণ্ঠ দিবস। সারা বিশ্বে প্রতিবারের নেয় এই দিবসটি পালিত হয়। এরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও পালিত হয়েছে। Read more

বাবা আছেন বলেই স্বপ্ন বেঁচে আছে
বাবা আছেন বলেই স্বপ্ন বেঁচে আছে

বাবার কাছেই স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। শিখেছি সৎ উপায়ে কিভাবে স্বপ্নকে সত্যিতে রুপান্তরিত করা যায়।

চিরনিদ্রায় শায়িত গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর
চিরনিদ্রায় শায়িত গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর

আরও একবার বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনে এলেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। কিন্তু এবার তাকে নিয়ে আসা হলো সাদা রঙের  লাশবাহী গাড়িতে।

ব্যাংক কীভাবে বড় ব্যবসায়ীদের সুদ মওকুফ করে দেয়
ব্যাংক কীভাবে বড় ব্যবসায়ীদের সুদ মওকুফ করে দেয়

জানা গেছে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তিনটি ব্যবসায়ী গ্রুপকে ৪ হাজার ২২৪ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করেছে। আর একটি বেসরকারি ব্যাংক Read more

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন