কখনো কখনো কোনো রাত পুরো জীবনের গায়ে এমনভাবে ছাপ ফেলে দেয়- যার দাগ কোনোদিন মোছা যায় না। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ছিল তেমনই এক রাত। উপকূলীয় জনপদের মানুষজন সেই রাতকে ভুলতে পারেননি, ভুলেননি। সে রাতে শুধু মানুষ হারায়নি, হারিয়েছিল ঘরবাড়ি, আত্মার বন্ধন, জীবনের মানে। ৩৫ বছর পরও সেই রাতের গর্জন উপকূলের বাতাসে শোনা যায়, ঢেউয়ে মিশে থাকা কান্না যেন আজও থামেনি।মহেশখালীর গোরকঘাটার সাবিনা ইয়াসমিন তখন মাত্র সাত বছরের শিশু। আজও ঘুম ভাঙে চিৎকার করে, বুক ধড়ফড় করে ওঠে ঢেউয়ের শব্দে। ঘর থেকে বেরিয়ে বাবার হাত ধরে ছিলাম, বলতে গিয়ে থেমে যান তিনি। চোখের কোণে জমে ওঠে কান্না। “হঠাৎ বিশাল এক ঢেউ এসে সব গুলিয়ে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবাকে ছুঁড়ে নিয়ে গেল সাগর। আমি আর তাকে ফিরে পাইনি। মা বলতেন, বাবা অনেক দূরে চলে গেছে। কিন্তু কোথাও তো কোনো কবরও নেই!”এ কেবল সাবিনার গল্প নয়, উপকূলের হাজারো পরিবারের বুকে আজও বাজে সেই রাতের আর্তনাদ। প্রতিটি বছর ২৯ এপ্রিল এলেই উপকূল থমকে যায়, বাতাস ভারী হয়ে ওঠে কান্নায়, জলোচ্ছ্বাসের শব্দে মিশে যায় দীর্ঘশ্বাস। সরকারি হিসাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন। কিন্তু সত্যিকার ক্ষতি? তা কোনো সংখ্যায় মাপা যায় না। কারণ এই ক্ষতি ছিল হৃদয়ের, সম্পর্কের, জীবনের যা এখনো সারেনি।কুতুবদিয়ার ধুরুং চরপাড়ার মোহাম্মদ হোসেনের স্মৃতি আজও থমকে আছে সেই রাতে। আমরা অভ্যস্ত ছিলাম ঝড়-বৃষ্টিতে। কেউ ভাবিনি, এভাবে সাগরের পানি আমাদের ঘরে ঢুকে পড়বে। এক মুহূর্তেই মা, বাবা, ভাই-বোন সবাই হারালাম। আজও কারও মরদেহ পাইনি। কুতুবদিয়ার নুরুল ইসলাম হারিয়েছেন ছোট ভাই জাহিদকে। ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরেও রাখতে পারিনি। সে শুধু একবার চিৎকার করে বলেছিল ‘ভাইয়া’। সেই শব্দটা এখনো কানে বাজে।পেকুয়ার হালিমা খাতুন হারিয়েছেন তার দুই সন্তান রিফাত ও রুমাইনা। ভোরে যখন পানি নামলো, দেখলাম ওরা পাশাপাশি পড়ে আছে। বুকের ওপর রেখে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। আজও তাদের কণ্ঠস্বর শুনি মনে হয়, কিন্তু কোথাও নেই।উত্তর ধুরুংয়ের মোজাম্মেল হক হারিয়েছেন মা, বাবা, স্ত্রী ও সন্তানকে। একসময় দশজন ছিলাম। এখন একা। যতবার কুতুবদিয়া যাই, বাতাসে তাদের কণ্ঠ শুনি মনে হয়। কেউ ফেরে না, শুধু সেই রাতটা বারবার ফিরে আসে।পেকুয়ার রহিমা বেগম বলেন, আমার ঘরে আলো ছিল তিন সন্তান। সেদিন রাতেই চলে গেল তিনজন। আমি মরিনি, কিন্তু মরে গেছি অনেক আগেই।কক্সবাজারের রাজঘাট ঘুরে দেখা গেল, বাঁধ ভাঙা, জেটি ভাঙা আর মন ভাঙা মানুষ। “আরেকটা ২৯ এপ্রিল এলে বাঁচার আশা নেই,” বলেন স্থানীয়রা। আজও বৃদ্ধারা কান্না করেন, শিশুদের শোনানো হয় সেই রাতের গল্প। কেউ কেউ এখনও খোঁজেন হারানো স্বজনদের নামের পাশে একটু চিহ্ন। কক্সবাজারে আশ্রয়কেন্দ্র আছে বটে, কিন্তু কাঠামোগত দুর্বলতা, দুর্ভোগ আর সময়ের সংকট এখনও বড় চ্যালেঞ্জ।জেলা প্রশাসক বলেন, নতুন কিছু কাজ হচ্ছে। তবে পুরনো বাঁধগুলো এখনো ঝুঁকিপূর্ণ। মানুষ সচেতন হলেও প্রকৃতি সময় দেয় না।ভয়াল ২৯ এপ্রিল কেবল একটি দিন নয়, এটি উপকূলবাসীর হৃদয়ের গহীনে থাকা এক ক্ষতচিহ্ন। যারা হারিয়েছে, তারা আর ফিরে আসবে না- তবু এই দিনে তারা ফিরে আসে স্মৃতিতে, বাতাসে, চোখের জলে। আর তাই ৩৫ বছর পরও থামেনি সেই রাতের আর্তনাদ। উপকূল আজও কান্না চেপে রাখতে পারে না।এসআর

Source: সময়ের কন্ঠস্বর

সম্পর্কিত সংবাদ
আজ আন্তর্জাতিক সুখ দিবস
আজ আন্তর্জাতিক সুখ দিবস

আজ ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক সুখ দিবস। মানুষকে সহজ, দৈনন্দিন সুখের অভ্যাস অনুশীলন করতে উৎসাহিত করে বিশ্বকে একটি মানবিক এবং সুখী Read more

নেত্রকোনায় হাওরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হাঁস পালন
নেত্রকোনায় হাওরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হাঁস পালন

কম খরচসহ বিনামূল্যে পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়ায় হাঁস পালনে আগ্রহী হচ্ছেন হাওরের যুবকরা। ধান এবং মাছের পাশাপাশি বিকল্প পেশা হিসেবে নেত্রকোনার Read more

আমরা নিরপেক্ষ নই ,    জনতার পক্ষে - অন্যায়ের বিপক্ষে ।    গণমাধ্যমের এ সংগ্রামে -    প্রকাশ্যে বলি ও লিখি ।   

NewsClub.in আমাদের ভারতীয় সহযোগী মাধ্যমটি দেখুন