একটানা দেড় মাস গোসল করতে পারেননি। খাবার তো দূরের কথা, টয়লেটের পানিও ছিল না। দিনের পর দিন কক্ষের মেঝেতে পড়ে থাকা কুকুরের মতো খাবার কুড়িয়ে খেয়েছেন। সেসব কথা মনে পড়তেই চোখ দিয়ে গড়াতে থাকে অশ্রু। অন্ধকার, মরুভূমি আর নির্যাতনে ভরা সেই জীবনের অভিজ্ঞতা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় কুড়িগ্রামের ইয়াকুব আলীকে।শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) বিকেলে র্যাব-৫ এর রাজশাহী সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বিভীষিকাময় প্রবাস জীবনের করুন চিত্র তুলে ধরেন ৩৮ বছর বয়সী ইয়াকুব। তিনি জানান, ইতালিতে স্বপ্নের চাকরি পাবেন—এমন প্রতিশ্রুতিতে প্রতারক চক্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ২০ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে পৌঁছেছিলেন আফ্রিকার মরুভূমির বন্দিশালায়।ইয়াকুব জানান, ২০২৩ সালের আগস্টে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হয় নওগাঁর জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। নিজেকে ইতালিপ্রবাসী ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়ে জাহিদ প্রলোভন দেখান উন্নত জীবনের। এরপর কথা হয় ভিডিও কলে। ইউরোপের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, বিলাসবহুল অফিস—সবই ছিল অভিনব প্রতারণার অংশ।জাহিদ ইয়াকুবকে প্রস্তাব দেন ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে ইতালিতে নিয়ে যাওয়ার। শর্ত ছিল ৫ লাখ অগ্রিম, বাকি টাকা পৌঁছানোর পর। প্রস্তাবে রাজি হয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে এমিরেটস এয়ারলাইন্সে দুবাই রওনা দেন ইয়াকুবসহ আরও ২৬ জন।দুবাই থেকে নাইজার হয়ে সড়ক পথে পাহাড়-পর্বত ও মরুভূমি পাড়ি দিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় আলজেরিয়ায়। সেখানে তিনদিন-তিন রাত অনাহারে কাটিয়ে অবশেষে পৌঁছান বন্দিশালায়। সেখানে দেড় মাস এক কক্ষেই আটক ছিলেন ২৭ জন। সেই বন্দিদশার বর্ণনায় ইয়াকুব বলেন, “দেড় মাস গোসল করতে পারিনি। টয়লেটের পানিও ছিল না। খাবার দেওয়ার সময় আফ্রিকানরা মেঝেতে ছুড়ে দিত। কুকুরের মতো আমরা সবাই কাড়াকাড়ি করে খেতাম। তখন বুঝেছি, মানুষ হয়েও পশুর চেয়ে অধম হয়ে পড়েছি।”আলজেরিয়া থেকে সীমান্ত পেরিয়ে তিউনিসিয়ায় নিয়ে গেলে পুলিশ আটক করে ইয়াকুবদের। ২১ দিনের জেল। এরপরও রেহাই মেলেনি। চক্রটি আবার তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে এবং রাতের আঁধারে লিবিয়ায় নিয়ে যায়। সেখানে একটি বাড়িতে আটকে রেখে চলে বর্বর নির্যাতন।ইয়াকুব বলেন, “মুখে গামছা পেঁচিয়ে আমাদের মারধর করত। জোরে গান চালিয়ে নির্যাতনের শব্দ চাপা দিত। আমাদের বিবস্ত্র করে ছবি-ভিডিও করে দেশে পরিবারের কাছে পাঠাত টাকা আদায়ের জন্য।” এই নির্যাতনে অংশ নেয় আফ্রিকান ও পাকিস্তানি কিছু লোক। নির্যাতনের ভিডিও দেখে আতঙ্কে থাকা পরিবার থেকে চক্রটি হাতিয়ে নেয় লক্ষ লক্ষ টাকা।দেশে ফিরে ইয়াকুব কুড়িগ্রাম সদর থানায় মামলা করেন। র্যাব-৫ জানায়, এই মামলায় মূল হোতা জাহিদ হোসেন (২৭) ছাড়াও তার বাবা এহরাম সরদার (৪০), চাচা বাবু মোল্লা (৫২), সহযোগী আব্দুল মান্নানসহ ছয়জনের নাম রয়েছে। এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কেবল জাহিদ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।যখন নির্যাতনের ভিডিও ও মুক্তিপণের তথ্য মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন লিবিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের হস্তক্ষেপে মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মো. খাইরুল বাশারের নেতৃত্বে ইয়াকুবসহ বাকিদের উদ্ধার করা হয়। দেশে ফিরে ইয়াকুব জানান, “সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় আবার সেই ঘরে ফিরে গেছি।”এই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইয়াকুব তরুণদের অনুরোধ করেন, “যাচাই না করে, কারও কথায় প্রলুব্ধ হয়ে বিদেশে পাড়ি দেবেন না। জীবনটাই হারিয়ে যেতে পারে।”তাদের মতো হাজারো যুবক এখনো নির্যাতিত হচ্ছেন প্রতারক চক্রের হাতে। অথচ এই সিন্ডিকেটের মূল নেটওয়ার্ক এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রশাসনের নজরদারি আর কঠোর আইনি পদক্ষেপ না থাকলে এই চক্র রোধ করা কি আদৌ সম্ভব? এমন প্রশ্ন ছুঁড়ছেন সুশীল সমাজ।এনআই
Source: সময়ের কন্ঠস্বর